দুঃখ লাগে জানেন, খুবই দুঃখ লাগে।
মানব সম্পদের এইরকম অপচয়ে।


এই অধম প্রত্যক্ষভাবে স্কুল শিক্ষার সাথে কোনদিনই জড়িত ছিল না। কয়েক বছর ধরে শিক্ষাঙ্গনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে মাত্র।


দুই ভিন্ন জগতের সাথে পরিচয় হচ্ছে।


কোভিড দুর্যোগের সময় একটা সুযোগ এসেছিল কিছু ছাত্রছাত্রীর সাথে পরিচিত হওয়ার। একটা অনলাইন ক্লাস চালু করার সূত্রে। অনেক মহানুভব শিক্ষক শিক্ষিকা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল। মূলত বাংলা মাধ্যমের সরকারী স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য 2020 সালের জুন মাস থেকে 2022 এর মাঝামাঝি পর্যন্ত যে অবৈতনিক অনলাইন ক্লাস চালানো হয়েছিল, তা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র স্বাতী ব্যানার্জী  ম্যাডাম, স্বাতী ভট্টাচার্য ম্যাডাম, রাম প্রসাদ দাস স্যার, দীপায়ন দাস, সুরজিত মন্ডল স্যার, সৌনক দাস , নীলাদ্রি চক্রবর্তী  স্যার, স্বদেশ জানা স্যার, জয়ন্ত সেন স্যার, সীমা দেবনাথ ম্যাডাম, শিল্পা  ম্যাডাম, মৌসুমী  ম্যাডাম, রেবেকা ম্যাডাম , সোহিনী ঘোষ ভট্টাচার্য ম্যাডাম, তনিমা গুহ ম্যাডাম, প্রীতি ম্যাডাম , জয় দত্ত স্যার , কৌশিক হালদার, তুহিন মুখার্জি, গার্গী, দীপ্ত মন্ডল  , শ্রী লেখা ব্যানার্জি, রূপালী গাঙ্গুলি ম্যাডাম, দীপায়ন দাস, অনুভব দে,রৌনক  মিত্র, তিলোত্তমা ম্যাডাম  , সিঞ্চিতা  ঘোষ, শ্রী কান্তন স্যার , পামেলা দত্ত ম্যাডাম এবং আরো অনেক মাননীয় শিক্ষক শিক্ষিকার মহানুভবতার জন্য। এঁদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ের মাননীয় শিক্ষক, শিক্ষিকা। নিজেদের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী না থাকলেও এনারা নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে এই প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছিলেন। কুর্নিস জানাই।
এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল। একার নয়। একা মানেই বোকা!!


অনেকে ছাত্র ছাত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। স্কুল খোলার পরে বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কয়েকজন তীব্র প্রতিবাদ করায় চালু রাখতে হয়েছে। সামান্য কয়েকজন। সুতরাং আমার পর্যবেক্ষণ খুবই সীমিত sample সাইজের ওপর। সাধারনীকরুন (,generalization) করা যায় না।


প্রধানত এদের পিতা মাতা শিক্ষক, শিক্ষিকা। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তুত করেন পিতা, মাতা। লোয়ার নার্সারি থেকেই প্রাইভেট টিউটর রেখে তার ওপরই ছেলে মেয়ের শিক্ষার সম্পূর্ন ভার ছেড়ে দিয়ে নিজেরা সিরিয়াল দেখতে বসে যান না। তারাও দেখিয়ে দেন, গাইড করেন, আটকিয়ে গেলে বুঝিয়ে দিতে পারেন। অবশ্যই যে সব ছাত্র ছাত্রী প্রথম পুরুষে বিদ্যালয়ে পা রাখছে, তাদের এই সুযোগ বা সৌভাগ্য হয় না।
দ্বিতীয়ত, ছাত্র ছাত্রীদের নিজের আগ্রহ থাকা চাই। একটা পজিটিভ reinforcement অবশ্যই বাবা মা, শিক্ষক শিক্ষিকারা বা পরিবেশ দিতে পারেন। উৎসাহ দেওয়াটা খুবই বড় ব্যাপার। বাচ্চারা যাতে হাল ছেড়ে না দেয় সেইজন্য লেগে থাকা দরকার। কথায় আছে, “You can take a horse to a pond, but you cannot make it drink।”


একটা উদাহরন দিচ্ছি।

অনেক বেসরকারী স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের অলিম্পিয়াড পরীক্ষা দেয়। তাদের গর্বিত বাবা, মায়েরা তাদের মেডেল গলায় ঝুলিয়ে ছবি পোস্ট করেন। দেখে মাথায় ভুত চাপলো – এদের দিয়ে ওইসব পরীক্ষা দেওয়ার।
এর আগে আমাদেরও কোন রকম ধারণা ছিল না এইসব পরীক্ষা নিয়ে। নেট ঘেঁটে কিছু কিছু জানলাম।


প্রথম বাধাই হল মাধ্যম। আগেই বলেছি এরা সবাই আগাগোড়া বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়েছে। কিন্তু অলিম্পিয়াড তো ইংরেজিতে। ফলে যা হওয়ার বুঝতেই পারছেন। অংক করবে কি, অংক তো আগে বাংলায় অনুবাদ করে বলে দিতে হচ্ছে। তারপরে তো অংক করবে। ইংরাজি প্রশ্নের কথা বা বিজ্ঞানের কথা না হয় বাদ দিলাম।


কিন্তু এরা পিছু হটলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গেলেন। “বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচ্যাগ্র মেদিনী!”
এবং যেটা বলেছিলাম বাবা মায়ের লেগে থাকা। তারাও এই পরীক্ষার বিষয় আমাদের মতই কিছুই জানতেন না। বইয়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে করে বই কিনলেন। আমাদের আবার সেইসব বইয়ের ছবি পাঠালেন। নিজেরাও ক্লাসে ছেলে মেয়ের সাথে বসে থাকলেন আর বিষয়টা বুঝে নিতে চাইলেন যাতে পরে ছেলে মেয়েকে বোঝাতে পারেন । অর্থ্যাৎ যাকে বলে Two step learning।


আর এরা পরিশ্রম করলো। অসম্ভব। দিনে তিন, চার ঘণ্টা ক্লাস। নিজেরা একই সময় বাড়িতে পড়া। প্রথম প্রথম সফলতা আসে নি। আমার মনে আছে আমি এদের “হেরো র দল” বলতাম।
কিন্তু পরিশ্রম কোনদিন বিফলে যায় না। ধীরে, ধীরে সাফল্য হল। আর এখন তো এরা যে কোন বোর্ডের যে কোন স্কুলের যে কোন ছাত্র ছাত্রীর সাথে compitition এ পিছিয়ে আসবে না। ইংরেজিতে কথা বলতে একটু হয়তো জড়তা আসবে, কিন্তু সেটাও কাটিয়ে উঠছেন। ভাষায় একটু তফাৎ তো থাকবেই। কারণ ওরা সব বইই ইংরেজিতে পড়েন। বাংলায় কথা বললেই মোটা অংকের টাকা ফাইন দিতে হয়। কিন্তু অংক, বিজ্ঞান আর ইংরেজিতে এরা সমানে টক্কর দেবে।


আর কথায় যেমন বলে, “জলে জল বাঁধে”, সেইরকম সফলতা ই সফলতার জন্ম দেয়। একবার যদি জেতার স্বাদ পায়, একবার যদি মেডেল গলায় ঝোলে, একবার যদি সার্টিফিকেট হাতে ধরে দেখে তাতে তার নাম লেখা আছে, তখন যে আনন্দ হয়, যে adrenaline ক্ষরণ হয়, সেই আনন্দই তাকে উদ্বুদ্ধ করে আরো সাফল্যের দিকে। বাবা, মাকে তখন আর গাড়ী ঠেলতে হয় না, গাড়ী স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। এরা এখন নিজেরাই খুঁজে বেড়ান কোথায় কোথায় পরীক্ষা হচ্ছে। একেই বলে Virtuous cycle।
এটা অনেকটা প্রদীপ জ্বালানোর মত। ভালো তুলোর সলতে চাই (ছাত্র ছাত্রীর আগ্রহ), প্রদীপে তেল ভরা চাই (বাবা, মায়ের লেগে থাকা), আর সলতেটাকে উসকিয়ে দেয়ার জন্য একটি দেশলাই কাঠি (শিক্ষক শিক্ষিকার গাইডেন্স)।
এই ছাত্র ছাত্রীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এই তিনের সংমিশ্রণ থাকলে শিক্ষার ক্ষেত্রে মাধ্যম কোন ব্যাপার নয়, বা বেসরকারী স্কুলের লাখ লাখ টাকা ফি দিয়েই শুধুমাত্র শিক্ষা অর্জন করা যায় না।


এবার আসি অন্য জগতের কথা।এটা সমাজের অন্য প্রান্তের। এদের দুঃখের বারো মাস্যার গল্প বলে আপনাদের মন ভারী করব না।
স্কুলে যায়। নিয়মিত কোচিংয়ে যায়। এই দুটি বিষয়ে বেশি কিছু বলব না। যারা অবগত আছেন, তাদের বলার দরকার নেই। যারা জানেন না তাদের না জানাই ভালো।
খুবই শোচনীয় অবস্থা। ভিত অতিশয় দুর্বল। তার ওপর উচুঁ ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবেন কি করে??
বিন্দুমাত্র এদের দোষ নেই। বেশীর ভাগই পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। স্কুল ছুটি।
কিন্তু কিছু জনের মধ্যে আগ্রহ আছে। চেষ্টা করে। বুদ্ধি ও আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আগের ক্লাসের কিছুই শেখে নি। স্কুল ছিল বন্ধ।
ধরুন ক্লাস 6 এ পড়ে। ভগ্নাংশ বা দশমিক সম্বন্ধে বিন্দু মাত্র জ্ঞান নেই। কারণ এগুলো ছিল ক্লাস 3, 4। তখন তো স্কুলেই যায় নি। আর বাড়ীর থেকে কোন রকম সাহায্য পায়নি পড়াশোনার ব্যাপারে। হয়তো খাতায় কলমে সেভেনে বা এইটে পড়ে। কিন্তু বিন্দু,রেখা, কোন, বিভিন্ন ধরনের ত্রিভুজ ইত্যাদি সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এঁদের দোষ নেই। সেসব জিনিস ক্লাস 5, 6 এ ছিল। ইংরেজির কথা ছেড়েই দিলাম।
ফলে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস কম, একেবারেই নেই। স্কুলে বা কোচিংয়ে হয়তো কিছু অংক বা ইংরেজির কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দেওয়া হয়েছে , সেগুলোই মুখস্থ করে যাচ্ছে। নিজে থেকে করার কোন আগ্রহ ই পাচ্ছেন না।
উৎসাহ পাচ্ছে না শেখার। Vicious circle ⭕।


তবে আশার কথা গুটি কয়েক নিয়মিত আসছেন। বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চলছে এদের পুরনো জিনিস ঝালিয়ে নেওয়ার। সাড়া দিচ্ছেন। শনিবার, রোববার সকালে চেষ্টা চলছে। 12 টা পর্যন্ত ক্লাস। কিন্তু একটা, দেড় টা পর্যন্ত থেকেই যান। “বাড়ী গিয়ে কী করবি,” একজন আর একজনকে বলেন। বাড়ী মানে কি জানেন?? বস্তির সরু গলি তস্য গলির ভেতরে আলো হাওয়া হীন ছোট্ট একটি কুঠুরি।
চেষ্টা করছি গরমের ছুটিতে সপ্তাহের প্রতিদিন সকালে এদের নিয়ে বসব। পয়লা মে থেকেই। এনারাও উৎসাহী। আর একটা অন্য রকমের লড়াই শুরু। দেখা যাক।
অবশ্যই “দেখলে হবে, খরচা আছে!” এই ধরনের প্রচেষ্টার জন্য অর্থের প্রয়োজন। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের অন্তত আসা যাওয়ার খরচ আর সামান্য সাম্মানিক প্রদান, যে সব ছাত্র ছাত্রী আসেন তাদের একটু জল খাবারের ব্যবস্থা, শিক্ষার সরঞ্জাম ইত্যাদি। “লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন” সেই গৌরী সেন মশাই দের আশায় আছি!!
হে মোর দুর্ভাগা দেশ।

Leave a Comment